পল্লব রাজবংশ

খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের প্রথমার্ধে সাতবাহন সাম্রাজ্যের পতনের পর কৃষ্ণা নদীর তীরে কাঞ্চি নগরকে কেন্দ্র করে পল্লব রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পল্লবদের আবির্ভাব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
  • পল্লবরা ছিল উত্তর ভারত থেকে আগত প্রাকৃত ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। কারণ লিপিগুলো দক্ষিণা ভারতের তামিল ভাষার পরিবর্তে রচিত হয়েছিল প্রকৃত ভাষায়।
  • পল্লবরা ছিল পারসীক পহ্লবদের সাথে সম্পর্কিত। এরা প্রথমে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসবাস করতো। এরপর এরা তোণ্ডামণ্ডলমে বসবাস করতো।
  • পল্লবরা ছিল তোণ্ডামণ্ডলমে বসবাসকারী আদিবাসী। এদের আদি পরিচয় ছিল 'পুলিন্দ' বা 'পালদ'। অশোকের শিলালিপিতে যে পুলিন্দ জাতির নাম পাওয়া যায়, কালক্রমে তারাই পল্লব নামে পরিচিতি লাভ করেন। অশোকের সময় তোণ্ডামণ্ডলম তাঁর সাম্রাজ্যের অংশ ছিল।

সাতবাহন শাসনামলে পল্লবরা সাতবাহনদের সামন্ত ছিল। ২২৫ খ্রিষ্টাব্দে সাতবাহন রাজ্যের পতনের পর, এরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম পর্যায়ে এঁরা ২৫০ থেকে ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে এদের রাজত্ব কাল ছিল ৩৫০ থেকে ৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দ। তৃতীয় পর্যায়ের রাজত্বকাল ছিল ৫৭৫ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

পল্লব রাজবংশের প্রথম পর্যায় (২৫০ থেকে ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ) ২২৫ খ্রিষ্টাব্দে সাতবাহন রাজ্যের পতনের পর, এরা স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে সে সময়ে সামন্ত রাজাদের মতো ক্ষুদ্র শক্তির অধিকারী ছিল। ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এরা প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌম রাজত্ব কায়েম করে। এই সময়ে পল্লবরাজ্যের রাজধানী কাঞ্চীতে ছিল। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নৃপতি ছিলেন শিবস্কন্দবর্মন। তিনি কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণে পেনাল্টি ও বেলারী অঞ্চল পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেছিলেন। কাঞ্চি ছিল তার রাজধানী। তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। শিবস্কন্দবর্মনের পর দীর্ঘদিন পল্লবদের কোনও প্রামাণিক ইতিহাস পাওয়া যায় নি।

পল্লব রাজবংশের দ্বিতীয় পর্যায় (৩৫০ থেকে ৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) দ্বিতীয় পর্যায়ের পল্লব রাজবংশে মোট ১৫ জন রাজার নাম নানা সূত্র থেকে জানা যায়। তবে এদের বিশেষ কোনো কৃতিত্বের কথা জানা যায় না। এরা ছোট পরিসরে নির্বিবাদে রাজত্ব করেছেন। এই সময়ে ছোট ছোট কিছু অংশে নতুন জনবসতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেছিলেন। এই সময় কোনো বড় ধরনে শত্রুর মোকাবেলা করতে হয় নি বা তারও কোনো রাজ্য আক্রমণ করার চেষ্টা করে নি। এই সময়ে পল্ল্বদের অগ্রগতির ধারাবাহিক উন্নতির কোনো ইতিহাসও জানা যায় না। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য নৃপতি ছিলেন বিষ্ণুগোপ এর নাম পাওয়া যায়। গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্যের যে সব রাজাকে পরাজিত করেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন কাঞ্চির বিষ্ণুগোপ।

পল্লব রাজবংশের দ্বিতীয় পর্যায় (৫৭৫ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ) এই পর্যায়ে প্রথম কৃতিত্ব সৃষ্টি করেন সিংহবিষ্ণু। ঐতিহাসিকভাবে তিনিই প্রথম পল্লব রাজবংশের বি্জয়ে গৌরব অর্জন করেন। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য পল্লব রাজাদের সম্বন্ধে নিচে আলোচনা করা হলো।

তৃতীয় সিংহবর্মন পল্লব বংশের একজন শাসক। যিনি খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাজত্ব করেছিলেন। তিনি সিংহবিষ্ণুর পিতা ও পূর্বসূরি। তাঁর রাজত্বের কোনও অবশিষ্টাংশ বা শিলালিপি নেই। তৃতীয় সিংহবর্মন সম্পর্কে তথ্যের একমাত্র উৎস হল তার পৌত্র প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের ভাইয়ালুর অনুদানের একটি বংশপঞ্জক।

সিংহবিষ্ণু (৫৭৫-৬০০ খ্রিস্টাব্দ):

  • ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহবিষ্ণু কাঞ্চির সিংহাসনে বসেন এবং এ সময় থেকেই পল্লবদের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায়।
  • ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহবিষ্ণুর আমল থেকেই তাদের প্রতিপত্তি ও গৌরবময় যুগের সূচনা হয়।
  • কৃষ্ণা থেকে কাবেরী পর্যন্ত তার আধিপত্য স্থাপিত হয়। সুদূর দক্ষিণের পাণ্ড্য, চের ও চোল রাজ্য তার বশ্যতা স্বীকার করে। তার আমল থেকেই চালুক্য শক্তির সঙ্গে পল্লবদের বিবাদের সূচনা হয়, যা দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসকে একশাে বছর ধরে প্রভাবিত করে। তিনি সিংহলের বিরুদ্ধেও সামরিক অভিযান পাঠিয়েছিলেন।
  • তিনি বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
  • তার আমলে মহাবলীপুরম শিল্পচর্চার এক বিখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত হয়।
  • কিরাতার্জুনীয়ম গ্রন্থের রচয়িতা বিখ্যাত কবি ভারবি তার সভাকবি ছিলেন।

প্রথম মহেন্দ্রবর্মন (৬০০-৬৩০ খ্রিস্টাব্দ):

  • ৬০০ খ্রিস্টাব্দে সিংহবিষ্ণুর পুত্র প্রথম মহেন্দ্রবর্মন সিংহাসনে বসেন।
  • প্রথম মহেন্দ্রবর্মন চালুক্য-রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর হাতে পরাজিত হন এবং বেঙ্গি প্রদেশটি তার হস্তচ্যুত হয়।
  • বিবিধ গুণাবলীর অধিকারী মহেন্দ্রবর্মন ত্রিচিনপল্লি, আর্কট ও চিঙ্গলপেট জেলায় বহু সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করেন। তিনিই প্রথম ইট ও কাঠের পরিবর্তে পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণ শুরু করেন। বহু মন্দির নির্মাণের জন্য তিনি চৈত্য কারী বলে পরিচিত ছিলেন।
  • নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন। তিনি সঙ্গীতশাস্ত্রের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত ব্যঙ্গ নাটক মত্তবিলাস প্রহসন সংস্কৃত ভাষায় তার দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি চিত্রকলার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন।
  • তিনি গুণভার উপাধি ধারণ করেন।
  • ভারবি, দণ্ডিন প্রমুখ গুণী সাহিত্যিকরা তার পৃষ্ঠপােষকতা অর্জন করেন।
  • তিনি প্রথম জীবনে জৈনধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং পরে শৈবধর্ম গ্রহণ করেন।
  • তার বিবিধ গুণাবলীর জন্য জনসাধারণ তাকে বিচিত্রচিত্ত বলে অভিহিত করে।
  • তিনি পল্লবমল্ল নামেও পরিচিত ছিলেন।

প্রথম নরসিংহবর্মন (৬৩০-৬৬৮ খ্রিস্টাব্দ):

  • প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের পুত্র পল্লব বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা প্রথম নরসিংহবর্মন ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।
  • তিনি মহামল্ল উপাধি ধারণ করেন।
  • চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীকে তিনি একাধিকবার যুদ্ধে পরাস্ত করেন, এমনকী তুঙ্গভদ্রা অতিক্রম করে তিনি চালুক্য রাজধানী বাতাপি অধিকার করেন এবং বাতাপিকণ্ডো উপাধি নেন। যুদ্ধে দ্বিতীয় পুলকেশী নিহত হন।
  • প্রথম নরসিংহবর্মনের রাজত্বের শেষদিকে দ্বিতীয় পুলকেশীর পুত্র প্রথম বিক্রমাদিত্যের নেতৃত্বে চালুক্যশক্তির পুনরুত্থান ঘটে। তার কাছে প্রথম নরসিংহবর্মন পরাজিত হন এবং তিনি চালুক্য রাজ্যের বেশ কিছু অংশ পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন।
  • নরসিংহবর্মন দক্ষিণে চোল, পাণ্ড্য, কেরল, কলভ্র শক্তিকে পরাস্ত করেন এবং দুবার সিংহলে নৌ অভিযান পাঠিয়ে তার অনুগত মানববর্মনকে সিংহলের সিংহাসনে বসান। বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশতে এই যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায়।
  • মহাবলীপুরমের বিখ্যাত রথ মন্দিরগুলি তার আমলেই তৈরি হয়।
  • চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কাঞ্চিতে আসেন।

দ্বিতীয় মহেন্দ্রবর্মন(৬৬৮-৬৭০ খ্রিস্টাব্দ)

  • ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নরসিংহ বর্মণের মৃত্যুর পর মহেন্দ্রবর্মণ দ্বিতীয় সিংহাসন লাভ করেন।
  • তিনি প্রথম বিক্রমাদিত্যের আক্রমণ প্রতিহত করে রাজ্য রক্ষা করার চেষ্টা করেন।

প্রথম পরমেশ্বরবর্মন (৬৭০-৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ):

  • ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পরমেশ্বরবর্মন সিংহাসনে বসেন।
  • এই সময় আবার চালুক্য-পল্লব দ্বন্দ্ব প্রবল আকার ধারণ করে। চালুক্য-রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর পুত্র প্রথম বিক্রমাদিত্য চালুক্য রাজ্য থেকে সকল পল্লব সেনা বিতাড়িত করেন। তুঙ্গভদ্রা অতিক্রম করে তিনি পল্লব রাজধানী কাঞ্চি দখল করেন এবং ত্রিচিনােপল্লি পর্যন্ত অগ্রসর হন। প্রথম পরমেশ্বরবর্মন অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাঞ্চি পুনর্দখলে সক্ষম হন।
  • গঙ্গরাজ্যের শক্তিবৃদ্ধি দেখে পরমেশ্বর শঙ্কিত হয়ে গঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন কিন্তু বিলন্দরের যুদ্ধে পরমেশ্বর পরাজিত হন। এই সুযোগে বিক্রমাদিত্যে পুনরায় পল্লবরাজ্য আক্রমণ করেন। পেরুবলানাল্লুর যুদ্ধে বিক্রমাদিত্যেকে তিনি পরাজিত করতে সক্ষম হন। এই সময় চালুক্যদের রাজধানী বাতাপির বেশিরভাগ অংশ দখল করে নিয়েছিলেন।
  • তিনি শৈব ধর্ম বিশ্বাসী ছিলেন এবং কাঞ্চিতে একটি সুরম্য শিবমন্দির নির্মাণ করেন।

দ্বিতীয় নরসিংহবর্মন (৬৯৫-৭২২ খ্রিস্টাব্দ):

  • প্রথম পরমেশ্বরবর্মনের পুত্র দ্বিতীয় নরসিংহবর্মন ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাজসিংহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন।
  • তার আমলে বিখ্যাত কৈলাসনাথের মন্দির তৈরি হয় এবং তিনি মহাবলীপুরমের মন্দিরগুলির নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ করেন।
  • তার রাজত্বকালে পল্লব স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে যে নতুন শিল্পরীতির বিকাশ ঘটে তার নাম রাজসিংহ রীতি।
  • তিনি শৈব ধর্মের অনুরাগী ছিলেন।
  • বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত দণ্ডি সম্ভবত তার সভাকবি ছিলেন।

দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মন (৭২২-৭৩০ খ্রিস্টাব্দ):

  • দ্বিতীয় নরসিংহবর্মনের পুত্র ৭২২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মন সিংহাসনে বসেন।
  • তার আমলে চালুক্যরা কাঞ্চি আক্রমণ করে,দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মন আত্মসমর্পণ করে এবং অবমাননাকর পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে দ্বিতীয় পরমেশ্বরবর্মণ চালুক্য রাজ্যে আক্রমণ করে কিন্তু দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য এর নিকট পরাজিত হয়ে ৭৩০ খ্রিস্টাব্দে নিহত হন।
  • পল্লব সাম্রাজ্য থেকে সিংহবিষ্ণুর বংশধরের অবসান হয়।

দ্বিতীয় নন্দীবর্মন (৭৩০-৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ):

  • রাজা দ্বিতীয় নদীবর্মন পল্লবমল্ল নামে পরিচিত ছিলেন।
  • তার পিতা ছিলেন হিরন্যবর্মন।
  • রাজত্বের প্রথমদিকে তাকে পাণ্ড্যদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। পল্লব শক্তির দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে চালুক্য-রাজ দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় নন্দীবর্মনকে পরাজিত করে কাঞ্চি দখল করেন এবং কাঞ্চির সিংহাসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী চিত্রমায়া-কে প্রতিষ্ঠা করেন। চিত্রমায়া প্রায় কুড়ি বছর পল্লব রাজ্য শাসন করেন। এ সময় দ্বিতীয় নন্দীবর্মন রাষ্ট্রকূট-রাজ দন্তিদুর্গের আশ্রয়ে ছিলেন।
  • দ্বিতীয় নন্দীবর্মনের এক অনুগত সেনাপতি উদয়চন্দ্র চিত্রমায়াকে হত্যা করলে (৭৪৬ খ্রিঃ) দ্বিতীয় নন্দীবর্মন আবার পল্লব সিংহাসন দখল করেন। সিংহাসনে বসে তিনি চালুক্য রাজ্য আক্রমণ করেন। চালুক্য রাজ কীর্তিবর্মন পরাজিত হন।
  • ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রকূটদের সঙ্গে পল্লবদের সংঘর্ষ বাধে। রাষ্ট্রকূটরাজ দন্তিদূর্গ চালুক্যদের রাজধানী কাঞ্চী অধিকার করেন। তবে শেষ পর্যন্ত দন্তিদূর্গ নিজের কন্যার সঙ্গে নন্দীবর্মনের বিবাহ দিয়ে মৈত্রী স্থাপন করেন।
  • তিনি গঙ্গরাজ শ্রীপুরুষকে পরাজিত করেন এবং গঙ্গ রাজ্যের কিছু অংশ দখল করেন।
  • দ্বিতীয় নন্দীবর্মন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি মুক্তেশ্বরের মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

দন্তিবর্মন (৭৯৬-৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ):

  • দ্বিতীয় নন্দীবর্মনের পুত্র দন্তিবর্মন সিংহাসনে বসেন।
  • তার আমল থেকে পল্লব বংশের পতন শুরু হয়। দক্ষিণ ভারতে পাণ্ড্যদের প্রবেশের ফলে পল্লব সাম্রাজ্য ছোট হতে থাকে।
  • ৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রকুট বংশের রাজা প্রথম ধ্রুব দন্তিবর্মনকে পরাজিত করে কাঞ্চি প্রবেশ করে।

তৃতীয় নন্দীবর্মন (৮৪৬-৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ):

  • এরপর দন্তিবর্মনের পুত্র তৃতীয় নন্দীবর্মন সিংহাসনে বসেন।
  • তিনি রাষ্ট্রকুট এবং গঙ্গাদের সাথে জোট করেছিলেন এবং তেলালারু যুদ্ধে পান্ড্যদের পরাজিত করেছিলেন। এরপরে তিনি বৈগাই নদী অবধি পিছু হটে পাণ্ড্য সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করেছিলেন। এরপর পুনরায় পাণ্ড্য রাজা শ্রীমার শ্রীবল্লভ পল্লব রাজ তৃতীয় নন্দীবর্মনকে কুম্বকোনামে পরাজিত করেছিলেন।
  • তৃতীয় নন্দীবর্মনের একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল এবং সিয়াম ও মালায়ার সাথে বাণিজ্য যোগাযোগ ছিল।

নরপাতুংবর্মন (৮৬৯-৮৮০ খ্রিস্টাব্দ)

অপরাজিতবর্মন (৮৮০-৮৯১ খ্রিস্টাব্দ):

  • ৮৮০ খ্রিস্টাব্দে অপরাজিতবর্মন সিংহাসনে বসেন। তিনি পল্লব বংশের শেষ রাজা।
  • তিনি ৮৯১ খ্রিস্টাব্দে চোল সামন্ত প্রথম আদিত্যর নিকট পরাজিত ও নিহত হন এবং পল্লব রাজবংশের অবসান হয়।

পল্লব সাহিত্য:

  • পল্লব রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতায় রাজধানী কাঞ্চি বিদ্যাচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।
  • পল্লব রাজারা সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন।
  • কিরাতার্জুনীয়ম কাব্যের রচয়িতা কবি ভারবি পল্লব রাজ সিংহবিষ্ণুর রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন।
  • কাব্যাদর্শ প্রণেতা দণ্ডিন দ্বিতীয় নরসিংহবর্মনের দরবারে ছিলেন।
  • পল্লব রাজ প্রথম মহেন্দ্রবর্মন একজন খ্যাতনামা লেখক ছিলেন। তিনি মত্তবিলাস প্রহসন ও ভগবদজ্জুকিয় নামে দুটি প্রহসন রচনা করেন। এছাড়া তিনি সঙ্গীতের উপরেও একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
  • বিখ্যাত সংস্কৃত পণ্ডিত ও ন্যায়ভাষ্য প্রণেতা বাৎস্যায়ন ছিলেন কাঞ্চির নাগরিক।
  • এই যুগে তামিল সাহিত্যও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। শৈব নায়নার ও বৈষ্ণব আলওয়ারদের রচিত ভক্তিমূলক গীতিগুলি তামিল সাহিত্যের পরিচয় বহন করে।
  • প্রসিদ্ধ আলওয়ার সন্ত ও পণ্ডিত তিরুমঙ্গাই এ যুগেই আবির্ভূত হন।

পল্লব স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা:

  • মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করেই পল্লব শিল্পের বিকাশ ঘটে।
  • রাজধানী কাঞ্চি, মহাবলীপুরম, আর্কট জেলা, ত্রিচিনােপল্লি প্রভৃতি স্থানে এই যুগে বহু সুদৃশ্য মন্দির নির্মিত হয়।
  • প্রকৃত দ্রাবিড় শিল্প ও ভাস্কর্যের প্রথম পরিচয় পল্লব শিল্প ভাস্কর্যের মধ্যেই পাওয়া যায়।
  • পল্লব মন্দিরগুলি ছিল দুধরনের — (১) পাহাড় কেটে বৌদ্ধ বিহারের অনুকরণে বা রথের আকৃতিযুক্ত মন্দির এবং (২) স্বাধীনভাবে তৈরি মন্দির।
  • পাহাড় কেটে মন্দির গঠনের পদ্ধতি সর্বপ্রথম পল্লবদের দ্বারাই আবিষ্কৃত হয়।
  • প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের আমলে ত্রিচিনােপল্লি, চিঙ্গলপেট ও আর্কট জেলায় পাহাড় কেটে বেশ কিছু সুন্দর সুন্দর মন্দির নির্মিত হয়।
  • প্রথম নরসিংহবর্মন রথের আকারে মন্দির নির্মাণ রীতি প্রবর্তন করেন। মহাবলীপুরমের এইসব রথ মন্দিরগুলির মধ্যে ধর্মরাজ রথ, দ্রৌপদী রথ, অর্জুন রথ ও ভীম রথ উল্লেখযােগ্য।
  • দ্বিতীয় নরসিংহবর্মনের আমলে নির্মিত কাঞ্চির কৈলাসনাথ মন্দির, বৈকুণ্ঠ পেরুমল মন্দির, ত্রিপুরান্তকেশ্বর ও ঐরাবতেশ্বর মন্দির এবং মহাবলীপুরমের মুক্তেশ্বর মন্দির পল্লব মন্দির স্থাপত্যের উল্লেখযােগ্য নিদর্শন।

পল্লব যুগের ধর্ম:

  • পল্লব রাজারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী হলেও পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন।
  • এই বংশের প্রথম উল্লেখযােগ্য রাজা সিংহবিষ্ণু বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন।
  • রাজা মহেন্দ্রবর্মন প্রথমে জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পরে তিনি শিবের উপাসনা শুরু করেন।
  • পল্লব সাম্রাজ্যে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল।